
ময়মনসিংহ গীতিকায় নারী বৈশিষ্ট
দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ১৯২৩ সালের কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় `ময়মনসিংহ-গীতিকা’। ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত ও চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত দশটি লোক গীতিকা এতে সংকলিত হয়।
প্রকাশের সংগে সংগে গীতিকা গুলি গুণী ব্যক্তির বিস্ময়-বিমুগ্ধ সমাদর লাভ করে। দীনেশ চন্দ্র- এর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করলে রোঁমা রোঁলা, মরিস মেটার লিংক, সিলভাঁ লেভি ও জর্জ গ্রায়ারসনের মতো মনীষী তার অকুষ্ঠ প্রশংসা করে।
পূর্ববঙ্গ গীতিকার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্ম নিরপেক্ষতা। শুধু যে কোন বিশেষ ধর্মমতের প্রতিফলন এতে ঘটেনি, তাই নয় বরং নরনারীর যে প্রনয়াবেগ ধর্মব্যঞ্জন ও সামাজিক শাসন অস্বীকার করে এই সব গীতিকায় সেই প্রনয়াবেগেরই স্তুতি করা হয়েছে। প্রেমই গীতিকা গুলোর উপজীব্য এবং সাধারণত সে প্রেম বিয়োগান্তক। সেখানে দেখি দেশকাল, ধর্ম নিরপেক্ষ এক সার্বজনীন হৃদয়ানুভূতির আধিপত্য।
প্রেমাস্পদের জন্য মহুয়ায় অপরসীম কষ্ট স্বীকার ও আত্মত্যাগ তার গৌরবময় উদাহরণ। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, গীতিকাগুলোতে নারীর বিশিষ্ট প্রাণ রয়েছে। যে প্রেমনিষ্ঠা চরিত্রকে মোহণীয় করে তুলেছে। এ নিষ্ঠা গীতিকার নারী চরিত্রকে শুধু দীপ্ত করে তুলেনি-তার ব্যক্তিত্ত্বের বিকাশও ঘটিয়েছে।
ময়মনসিংহ-গীতিকায় নিঃস্বার্থ নারী প্রেমের চরম দৃষ্টান্ত মলুয়া সুন্দুরী।
সুন্দুরী মলুয়াঃ
`কি ক্ষেণে আইলাম আমি এই গেরামের বাটে পরান রাখিয়া গেলাম এইনা জলের ঘাটে।”
যে কন্যাকে দেখে চাঁদ বিনোদন এইকথা ভাবে তার নাম ‘মলুয়া’। জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে দূর গেরামে জলের ঘাটে হঠাৎ দেখি দুজনার।
‘ভিনদেশী পুরুষে ˜দেখি চান্দের মতন- লাজ রক্ত হইল কন্যার পরথম যৈবন।”
বিয়ের প্রস্তাব পাঠান বিনোদ: মলুয়ার আবা-মা কোন পরানে এমন পাত্রের হাতে তুলে দেবে মেয়েকে?
‘এক মুষ্টি ধান নাই লক্ষী পূজার তরে- কি খাইয়া থাকিব কন্যা এই দরিদ্রের ঘরে !”
তখন প্রতিজ্ঞা করে এক বছরের ভেতরে নিজের অবস্থা ফেরায় বিনোদ। মলুয়ার সাথে তার কোন বাঁধা থাকবে না।
‘বাড়ির শোভা বাগ-বাগিচা-ঘরের শোভা বেড়া, কুলের শোভা ঘরের বউ- শ্বাশড়ির বুক জুড়া।”
তার পর –
‘বউ পাইয়া বিনোদের মাও পরম সুখী হইল, ঘর-গিরস্তি যত সব যতনে পাতিল।”
কিন্তু এই ঘর গিরস্তি বুঝি যায় : সুস্দরী মলুয়ার দিকে চোখ পড়ে কাজীর। মলুয়কে পাবার জন্য সে পাঠায় এক কুটনী বুড়িকে। বুড়ির মুখে কুপ্রস্তাব শুনে গর্জে ওঠে মলুয়া।
‘আমার সোয়ামী সে যে পর্বতের চুড়া, আমার সোয়ামী যেমন রনদৌড়ের ঘোড়া। আমার সোয়ামী যেমন আসমানের চাঁদ না হয় কাজী তার নউখের সমান।”
কাজী নিজে সুবিধা করতে না পেয়ে এবার দেশের দেওয়ানের কানে তুলে দেয় মলুয়া অসামান্য রুপের কথা। মলুয়াকে দেওয়ান বেঁধে এনে রাখে তার অন্দর মহলে কিন্তু তার সতীত্ব নস্ট করতে পারে না। বুিদ্ধর খেলাতেই দেওয়ানকে পরাজিত করে মলুয়া নিজের সংসারে ফিরে আসে।এখন বিরুপ হয় সমাজ।
বিনোদের মামা বলে হালুয়ার সন্দার ঘরে যেই তুইলা লইব জাতি যাইব তার কারণ –
‘রাজার ঘরে নারী কত রক্ষা নাইত পায়।’
সমাজের ভয়ে বিনোদ ত্যাগ করে সতী মলুয়াকে।
এ পালায় রচয়িতা করি চন্দ্রাবতী নিজে নারী। তার নিজের জীবনও বড় দুঃখের। মলুয়াকে তিনি তুলে দেন নৌকায়। মলুয়া এখন আত্মহত্যা করবে। সবাই ছুটে আসে , সবাইকে মলুয়া অনুরোধ করে ফিরে যেতে। মলুয়ার নৌকা মাঝ গাঙ্গে যায়।
মলুয়া বিনোদের দিকে তাকিয়ে শেষ বারের মত বলে-
‘ উঠুক উঠুক পানি- ডুবুক ভাঙ্গা নাও। অভাগীরে রাইখা সোয়মী তুমি ঘরে ফির্যা যাও।”
তার পর –
পুবাইলে গর্জিল দেওয়া ছুটল বিষম বাও- কইবা গেলা সুন্দর কন্যা মন পাবনের নাও।”( সংগৃহিত)