
যখন থেকেই মধ্যযুগের সূচনা ধরা হোক না কেন, তার উপর খৃস্টধর্মের প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। গোটা মধ্যযুগের ইউরোপে রাষ্ট্রদর্শনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণীর যাজকগণ; তাঁরা রাষ্ট্রদর্শনকে সুনির্দিষ্ট ধারায় পরিচালিত করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করেননি, বরং সৃষ্টি করেছেন এক তমস যুগের।
রাষ্ট্রদর্শনে খৃস্টীয় ধর্ম মতবাদের উপকরণগৃ়ুলো নিতে আলোকপাত করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রকে দৈব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হতো; কারণ রাষ্ট্র ঈশ্বরের সৃষ্টি– এধরনের একটি ধারণা গোড়ার দিকে পোষণ করা হতো। মনে করা হতো, রাষ্ট্র পবিত্র প্রতিষ্ঠান হলেও মানুষের পাপের ফলেই এর সৃষ্টি হয়; কিন্তু মানুষের পাপের কারণে এর সৃষ্টি হলেও, ঈশ্বরের সৃষ্টি বলেই একে পবিত্র জ্ঞান করা হতো।
সেসময় একটা কথা বহুবার উচ্চারিত হতো: সিজারের যা পাওনা তা সিজারকে দাও এবং ঈশ্বরের যা পাওনা তা ঈশ্বরকে দাও।
সিজার ইহজাগতিক অধিকর্তা এবং ঈশ্বর পারলৌকিক অধিকর্তা; যথাক্রমে রাষ্ট্র ও গীর্জায় তাঁদের অধিষ্ঠান। ব্যক্তিকে যেমন কার্ংযক্ষম নাগরিক হতে হয়, কেমন হতে হবে খৃস্টান। ব্যক্তিকে দুইদিকেই আনুগত্য প্রকাশ করতে হয় এবং যে যে ক্ষেত্রে যার যার যা যা পাওনা তা তা তাকে তাকে মিটিয়ে দিতে হবে|
গোড়ার দিকেএই পাওনা নিয়ে তেমন কোন গোলযোগ দেখা দেয়নি| কিন্তু ধীরে ধীরে পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে দেখা দিতে থাকে অন্তর্বিরোধ, দেনাপাওনা নিয়ে সৃষ্টি হয়ে জটিলতার। গীর্জা রাষ্ট্রের উপর এবং রাষ্ট্র গীর্জার উপর প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালায়
মূলতঃ রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় মনীষীগণ মৌলিক কোন অবদান সংরক্ষণ করতে পারেননি। রাষ্ট্রদর্শনের চর্চা ছিল সীমিত ও অবিকশিত। এ প্রসঙ্গে ড. এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ‘মধ্যষুগের রাষ্ট্রচিন্তা’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন:
“মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় আর যাই থাক ‘রাষ্ট্র’ ছিল না, আর মুক্ত ‘চিন্তা’ও ছিল না| রাষ্ট্রনীতি ছিল ন্যায়শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব ও আমন্ত্রণ গহ্বরে বন্দিনী| অন্য কথায় অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি ছিল ন্যায়শাস্ত্রের অনুগত এবং ন্যায়শাস্ত্র ঐশীবাণীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় তা ছিল ধর্মতত্ত্বের অনুগত|”
একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আর. জি. গেটেলের ‘History of Political Thought’ গ্রন্থে:
“রোমান আইনশাস্ত্রের প্রচারের কথা বাদ দিলে গ্রীক নগররাষ্ট্রের পতনের পর থেকে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয় পর্যন্ত দর্শন ছিল মূলতঃ অরাজনৈতিক|”
রাষ্ট্রচিন্তায় যাজকদের কর্তৃত্বের ছায়া- আগামি সংখ্যায় পড়ুন বাকিটা