
রাষ্ট্র বনাম গীর্জা
ইউরোপে রোম সাম্রাজ্য তখন মিথ-এ পরিণত। ইউরোপীয় জনগণের ধারণা ছিল, সাম্রাজ্য হিসেবে রোমের পতন কখনো ঘটতে পারে না, রোমবাসীরা কখনো পরাজয় মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে রোমীয় বাহিনী সে যুগের সেরা বাহিনী। মানুষের গড়া সভ্যতা মানুষ নিজেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
কালের চক্রে ভেঙ্গে পড়ল রোম সম্পর্কিত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, প্রচলিত মিথ; বর্বর ফ্রান্ক, হুন জাতিদের কাছে পর্যুদস্ত হলো রোমীয় বাহিনী, তছনছ হলো রোমের সীমান্ত।
রোমের পতন ইউরোপীয় অধিবাসীদেরকে চিন্তিত ও আতংকগ্রস্ত করে তুলেছিল। প্যাগানপন্থীরা এই পতনের জন্য খৃস্টধর্মকে অভিযুক্ত করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল: এতোদিন পর্যন্ত রোম সাম্রাজ্য সগৌরবে অবস্থান করছিল, এর উপর ছিল দেবতাদের আশীর্বাদ। খৃস্টধর্মের অনুপ্রবেশ ও প্রসারের ফলে দেবতাগণ জনগোষ্ঠীর প্রতি বিমুখ হয়ে পড়েন এতে জনগণকে অভিসম্পাত দেন।
এরই ফলশ্রুতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অজেয় সাম্রাজ্যটির পতন। খৃস্টধর্মের অন্তর্নিহিত এমন কোন শক্তি ছিল না যা রোমকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত। প্যাগানপন্থীদের এমন চিন্তাধারার বিপরীতে জবাব দিতে খৃস্টীয় রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণকে মধ্যযুগের গোড়ার দিকে অবদান রাখতে দেখা যায়।
দুজন শক্তিশালী সম্রাট ডায়োক্লোটিয়ান ও কনস্ট্যানটাইন রোমকে প্রাচীনতার স্বপ্ন-রাজ্যে অধিষ্ঠিত করার ও সুসংগঠিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁদের এ প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
বরং সম্রাট কনস্ট্যানটাইন বিরোধের বীজ উপ্ত করেন। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার সূত্রপাত ঘটে তাঁরই কর্মধারার মাধ্যমে| কনস্ট্যানটাইন খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং খৃস্টধর্মকেই রাজধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার ভালো আপৎকালীন সময়ের জন্য রাষ্ট্র ও গীর্জার মধ্যে সমন্বিত ভাবধারার সৃষ্টি হলেও কালক্রমে তা শুভযোগে সুফলদায়ক হিসেবে গণ্য হয়নি।
রাজশক্তি ভাবতে শুরু করেছিল যে গীর্জা তারই অধীনস্থ দফতর বিশেষ; পারলৌকিক বিষয়ক ধর্মে-কর্মে রাজশক্তির থাবা বিস্তারিত হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
শীঘ্রই যাজকদের মধ্যে তাঁদের স্বার্থহানীর ও আত্মমর্যাদা বোধের সংক্রমণ ঘটে। তাঁরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। প্রথমদিকে তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতে গীর্জার সার্বভৌমত্ব দাবী করেন। একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই দাবীরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কিন্তু এর পরপরই যাজকদের দাবীর ক্ষেত্র ও পরিধি আরো বিস্তৃত হতে থাকে।
তাঁরা সম্রাটকে গীর্জার অধীনস্থ বলে দাবী করেন। এমন দাবী সম্রাটের কর্মক্ষমতা, এমনকি মূল অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক ছিল। ফলে রাষ্ট্র ও গীর্জার মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা পরিলক্ষিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে প্রচন্ড বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই বিরোধ অহিংস ছিল না| ইউরোপের এ যুগের ইতিহাস তাই রক্ত রঞ্জিত ইতিহাস। বন্ধ্যা-রাষ্ট্রচিন্তায় দ্বন্দ্বমুখর ইউরোপীয় মধ্যযুগ অন্ধকারে আচ্ছন্ন।……………..
রাষ্ট্র বনাম গীর্জা আগামি সংখ্যায় পড়ুন